ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (১৮৪৮)-এর কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো ꘡ What were the causes and effects of the february revolution - equiz4u

প্রশ্ন ঃ ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লব (১৮৪৮)-এর কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।

উত্তর ঃ ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের দ্বারা ফরাসি জনগণ অর্লিয়েন্স বংশোদ্ভূত লুই ফিলিপকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসান। লুই ফিলিপও জনগণের ক্ষমতার দ্বারা স্মরণ রেখে চিরাচরিত স্বৈরাচারী শাসনের পরিবর্তে উদার শাসন-নীতি প্রবর্তন করেন। নিজ পুত্রদের সাধারণ বিদ্যালয়ে শিক্ষাদান, বিপ্লবের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকা গ্রহণ, নেপোলিয়ন বোনাপার্টের দেহভঙ্গ এনে মনোরম সৌধ নির্মাণ ও বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজের মাধ্যমে তিনি 'নাগরিক রাজতন্ত্রের' সূচনা করেন। পররাষ্ট্রক্ষেত্রে তাঁর মূলনীতি ছিল শান্তি বজায় রাখা এবং বানিজ্যের প্রসার ঘটানো। এইভাবে দেশের সকল শ্রেনির মানুষের সন্তুষ্টি বিধান ও দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন লুই ফিলিপের শাসনের প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া সত্ত্বেও নানা কারণে ফরাসি জনগণ তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিপ্লব শুরু করে। দেশের আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অসন্তোষই ছিল উক্ত বিপ্লবের প্রধান কারণ। 

আভ্যন্তরীণ কারণ ঃ লুই ফিলিপের শাসনব্যবস্থা প্রথম থেকেই দুর্বল ছিল। তাছাড়া লুই ফিলিপের শাসনের পিছনে কোন প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলেরও সমর্থন ছিল না। 

          প্রথমত ঃ প্রজাতন্ত্রীগণ আশা করেছিল লুই ফিলিপ উদার শাসননীতি অনুসরণ করবেন, এবং শ্রেণি নির্বিশেষে ফরাসি জাতির উন্নতি সাধন করবেন। জ্যাক ড্রুজের ভাষায় - জেদি ও নীতিজ্ঞানহীন নাগরিক রাজা আপাত ভালো মানুষীর অন্তরালে স্বৈরাচারী ক্ষমতা ভোগের তীব্র বাসনা করতেন। কিন্তু লুই-এর নীতি না ছিল রক্ষণশীল, না ছিল উদারপন্থী। প্রজাতান্ত্রিকদের কাছে ফিলিপের শাসন ছিল একক অধিনায়কত্বের নামান্তর। তাই প্রথম থেকেই এরা তাঁর বিরোধিতা করতে থাকে।

          দ্বিতীয়ত ঃ ন্যায্য অধিকার নীতিতে বিশ্বাসী বুরবো বংশের সমর্থকগণ ফরাসি সিংহাসনে বুরবো বংশেরই কোন ব্যক্তিকে বসানোর পক্ষপাতী ছিলেন। তারা লুই ফিলিপকে অনধিকারী বলে মনে করত এবং তাঁর প্রতি এদের কোন আনুগত্য ছিল না। 

          তৃতীয়ত ঃ নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সমর্থকদের নিয়ে গঠিত 'বোনাপার্টিস্ট' দল নেপোলিয়নেরই বংশধরকে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসানোর পক্ষপাতী ছিল। 

          চতুর্থত ঃ লুই ব্ল্যাঙ্ক-এর নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রী দলও লুই ফিলিপের বিরোধিতা করতে থাকে। শিল্প প্রসারের সাথে সাথে ফ্রান্সে বহু শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছিল। শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। শ্রমিক সংগঠন স্থাপন করা ছিল বে-আইনি। শ্রমিকদের মজুরি এবং চাকুরির শর্তাবলী মালিকদের ইচ্ছা নির্ভর ছিল। লুই ফিলিপের পতনের পিছনে শ্রমিক শ্রেণি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। 

          পঞ্চমত ঃ উগ্র ক্যাথলিকগণ ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের পক্ষপাতী ছিল না। তারা বুরবো আমলের মত সকল রকম ধর্মীয় ও সামাজিক সুযোগ সুবিধা লাভে আগ্রহী ছিল। তাই তারা ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের বিরোধিতা করতে থাকে। 

পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতা ঃ লুই পররাষ্ট্র নীতির ব্যর্থতা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের জন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল। ভিয়েনা কংগ্রেসে গৃহীত ব্যবস্থাদির দ্বারা ফ্রান্সের মর্যাদা হানি ঘটেছিল। ফরাসিবাসীর আশা ছিল লুই ফিলিপ বলিষ্ঠ ও চমকপ্রদ পররাষ্ট্রনীতির দ্বারা ফ্রান্সের হৃত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সম্ভব হবেন। কিন্তু তিনি একাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। ইতালি ও পোল্যান্ডে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলে ফরাসিবাসী আশা করেছিল সরকার সক্রিয়ভাবে জাতীয়তাবাদীদের সাহায্যে অগ্রসর হবেন। কিন্তু এক্ষেত্রে লুই নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করেন। বেলজিয়ামের স্বাধীনতা আন্দোলনে লুই ফিলিপ ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পামারস্টোনের কূটনীতির কাছে পরাজিত হলে ফরাসিবাসী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মিশরের পাশা মেহমৎ আলী তুরস্ক আক্রমণ করলে ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়া প্রভৃতি দেশ তুরস্কের পক্ষ অবলম্বন করে। কিন্তু লুই ফিলিপ মিশরের পাশার পক্ষ গ্রহণ করে। ফলে পূর্বাঞ্চলে ফ্রান্সের আধিপত্য ও সুনাম বিনষ্ট হয়। স্পেনের রাজকন্যার সাথে নিজের পুত্রের বিবাহ দিয়ে ফিলিপ বিদেশে ফ্রান্সের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেন এবং ইংল্যান্ডের সাথে সম্পর্ক তিক্ত করে তোলেন। অস্ট্রিয়ার সাথে মিলিতভাবে সুইজারল্যান্ডের প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বীদের দমন করে তিনি জাতীয়তাবাদী ফরাসিবাসীর বিরাগভাজন হন। সেই সময়ে ফিলিপের আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করা ছিল লাভজনক। কিন্তু ইংল্যান্ডের ভয়ে লুই ফিলিপ আফ্রিকায় ফরাসি উপনিবেশ বিস্তারের সুযোগ গ্রহণ করেননি। এইভাবে দেখা যায় আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্র - উভয় ক্ষেত্রেই ফিলিপের শাসনব্যবস্থা ফরাসি জনগণকে হতাশ করে তোলে। সেই সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থনৈতিক মন্দা, দেশে খাদ্যাভাব, বেকারী দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। শ্রমিকশ্রেণীর ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ সাধারণ মানুষের হতাশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে শুরু করে দেশব্যাপী আন্দোলন।


প্রত্যক্ষ কারণ ঃ আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে লুই ফিলিপের ব্যর্থতা যখন ফরাসিবাসীকে উত্তপ্ত করে তুলেছিল, সেই সময়ে ভোটাধিকারের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বিপ্লবের আগুন জ্বলে ওঠে। ফ্রান্সের প্রতিনিধি সভায় নির্বাচন পদ্ধতি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। দুর্নীতি ও প্রলোভন দ্বারা ভোট সংগ্রহ সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এইসব ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করণার্থে প্রতিনিধি পরিষদে এক সংস্কারপন্থী দলের উদ্ভব হয়। সেই দলের নেতা ছিলেন থিয়ার্স। এই দল ভোটাধিকার সম্প্রসারণের দাবিতে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। কিন্তু ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী গিজো তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন এই দল জনসভার আয়োজন করে গিজোর পদত্যাগ দাবী করে। বাধ্য হয়ে লুই ফিলিপ গিজোকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু গিজোর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভরত জনতার ওপর নিরাপত্তা বাহিনী গুলিবর্ষণ করলে সারা দেশে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে (১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে)। লুই ফিলিপ সিংহাসন ত্যাগ করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে যান। বিপ্লবীগণ ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। ফেব্রুয়ারী মাসে সংগঠিত বলে এই বিপ্লব 'ফেব্রুয়ারি বিপ্লব' নামে পরিচিত। 

ফলাফল ঃ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে সমাজতন্ত্রবাদী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নতুন সংবিধান অনুযায়ী ৭৫০ সদস্যের এক কক্ষযুক্ত আইনসভা গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। আরও স্থির হয় যে, জনসাধারণের ভোটে একজন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। তার কার্যকাল হবে চার বছর। এক ব্যক্তি দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি পদে বসতে পারবেন না। এই বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কর্তৃত্ব লোপ পায় এবং সাধারণ মানুষের জয় ঘোষিত হয়। শ্রমিকের উপযুক্ত মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা, বর্ণান্ধতা ও দারিদ্র্য - এই দুই প্রকার দাসত্ব থেকে মানুষকে মুক্ত করা, মানুষকে স্বমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা প্রভৃতি সরকারের নীতি রূপে স্বীকৃতি লাভ করে।
equiz4u

Post a Comment

0 Comments