১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের কারণ ꘡ The causes of revolt of 1857

১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের কারণ

       অষ্টাদশ এবং ঊনবিংশ শতকে ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের পুরোধা ভারতীয় সিপাহীগণ থাকলেও, এই বিদ্রোহ কেবলমাত্র সিপাহিদের দ্বারা পরিচালিত হয়নি, এর পেছনে ছিল বহুজনের বহুদিনের পুঞ্জীভূত একাধিক অসন্তোষ। তাই ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, " ভারতের সমস্ত শ্রেনীর মানুষই ইংরেজদের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ ছিল। সুতরাং সব শ্রেণীর মানুষের ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়াই ছিল স্বাভাবিক ঘটনা"। বিদ্রোহের কারণ সম্পর্কে এ. আর. দেশাই বলেছেন, "১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ শাসনে নির্যাতিত বিভিন্ন শ্রেণীর ভারতবাসীর সম্মিলিত অসন্তোষের ফল। এই অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক বিস্তৃতি, অর্থনৈতিক শোষণ এবং সামাজিক উদ্ভাবন থেকে"।

➡ প্রত্যক্ষ কারন :  

                     ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এনফিল্ড রাইফেলের প্রচলন মহাবিদ্রোহের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে গণ্য করা যায়। এই এনফিল্ড রাইফেলের কার্তুজের -এর মুখ চর্বি মাখানো এক ধরনের মোড়ক দ্বারা আবৃত থাকত। এই মোড়কটি দাঁতে কেটে ভরতে হত। মোড়কটিতে গরু ও শূকরের চর্বি  মেশানো আছে বলে গুজব রটে। ধর্মনাশের  আশঙ্কায় হিন্দু ও মুসলিম সিপাহীরা এই কার্তুজ  ব্যবহারে অসম্মতি জানালে উচ্চপদস্থ ইংরেজ সামরিক অফিসাররা সিপাহীদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপর সিপাহীরা তাদের ছাউনি ছেড়ে পথে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। ফলে শুরু হয় ১৮৫৭ -এর মহাবিদ্রোহ। 

➡ রাজনৈতিক কারণ :

      ১. অধীনতামূলক মিত্রতা নীতি ঃ লর্ড ওয়েলেসলি প্রবর্তিত এই নীতির দ্বারা দেশীয় রাজ্যগুলিকে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক আক্রমণ থেকে নিরাপত্তা দেওয়ার শর্তে তাদের ইংরেজদের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করানো হয়। এই নীতির মাধ্যমে হায়দ্রাবাদ, সুরাট, অযোধ্যা, কর্ণাটক, যোধপুর,উদয়পুর ইত্যাদি দেশীয় রাজ্য ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণাধীন হয়। 

     ২. স্বত্ববিলোপ নীতি ঃ লর্ড ডালহৌসি প্রবর্তিত এই নীতিতে বলা হয়, কোন রাজ্যের রাজা যদি অপুত্রক  অবস্থায় মারা যায়,তবে সেই রাজ্যটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হবে, সাথে সাথে সেই রাজার কোন দত্তক পুত্র থাকলে তার অধিকার বাতিল করা হবে। এই নীতির ফলে সম্বলপুর, উদয়পুর, কর্ণাটক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। উল্লেখ্য যে, এই নীতির ফলে পেশোয়া দ্বিতীয় বাজিরাও-এর দত্তক পুত্র নানাসাহেবের ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। 

      ৩. নিরাপত্তা হীনতা বোধ ঃ দেশীয় রাজ্যগুলি ইংরেজদের অধিকারে যাওয়ার ফলে শুধুমাত্র রাজপরিবার  নয়, ক্ষতি হলো আরো শত শত পরিবার। এরা রাজপ্রাসাদের কর্মী হিসেবে জীবন যাপন করতে থাকে এবং সেই সাথে সাথে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্তির  ফলে আশ্রিত রাজারা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে। এর ফলে ত্রিবাঙ্কুর, কাথিয়াবাড়, রাজপুতানা সহ বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যগুলি ব্রিটিশ শাসন মুক্ত হওয়ার জন্য বিদ্রোহ ঘোষণা করতে থাকে। এ প্রসঙ্গে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, "who could be safe, if the British thus treated on who had ever been their most faithful ally?"

      ৪. উপাধি বিলোপ ও রাজ্যগ্রাস ঃ ইংরেজরা বিভিন্ন কুখ্যাত আইন তৈরি করে বা কখনও কুশাসনের অজুহাতে একের পর এক ভারতীয় স্বাধীন দেশীয় রাজ্যগুলিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন করতে থাকে। সেই সাথে সাথে সেই সব রাজ্যের রাজাদের উপাধির বিলোপ ঘটাতে থাকে। এইভাবে বাহাদুর শাহ তাঁর উপাধি হারান। 

অর্থনৈতিক কারণ :

       ১. শোষণ ঃ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের একটা অন্যতম বড় কারণ ছিল ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থনৈতিক শোষণ। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানি ভারতের সম্পদ (সোনা,রুপো) শোষণ করে ইংল্যান্ডে প্রেরণ করতে থাকে এবং ইংল্যান্ডকে আর্থিক দিক থেকে শক্তিশালী করতে থাকে। এর ফলে সর্বস্তরের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

      ২. বিনাশুল্কে বাণিজ্য ঃ ভারতে কোম্পানি বিনাশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পাওয়ার পর তারা এদেশে একচেটিয়া বাণিজ্য করায় ভারতীয় ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়ে। ফলস্বরুপ ভারতবর্ষের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। 

      ৩. বিভিন্ন বন্দোবস্তের চাপ ঃ কোম্পানি প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত, মহলওয়ারি বন্দোবস্ত, তালুকদারি বন্দোবস্ত প্রভৃতি বন্দোবস্তগুলি  ভারতীয় ছোট-বড়ো কৃষকদের ওপর শোষণের মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছিল। আর এই সব বন্দোবস্ত ব্যবস্থায় কৃষকদের উচ্চ হারে সুদ প্রদান করতে হত। 

       ৪. মহাজনদের অত্যাচার ঃ কোম্পানির শাসনে সুদখোর মহাজন ও নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে ছিল। কৃষকরা অতিরিক্ত রাজস্বের চাপে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হত। আর তা ছিল অত্যন্ত চড়া সুদের বিনিময়ে। আর এদিকে কোম্পানি  চাষীদের নীলচাষে বাধ্য করত। সাধারণত নীলচাষ ছিল অলাভজনক আর এই নীল করে নীলচাষীদের সুদ প্রদান করার পর তাদের হাতে কিছুই বেঁচে থাকত না। কিন্তু এর অন্যথা করলে চাষীদের ধরে নিয়ে গিয়ে কুঠি বাড়িতে  আটকে রাখা হতো এবং সাথে চলত শারীরিক নির্যাতন। 

➡ সামরিক কারণ :

      ১. স্বল্প বেতন ঃ ভারতীয় সিপাহীদের বেতন অত্যন্ত কম ছিল। সিপাহিদের আনুষাঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও কম ছিল। এদের পদোন্নতির সুযোগ সুবিধা ছিল না বললেই চলে। এই প্রসঙ্গে ইংরেজ ঐতিহাসিক হোমস্ লিখেছেন, "একজন সিপাহী হায়দার আলীর মতো নৈপুণ্য দেখিয়েও একজন সাধারণ ইংরেজ সৈনিক -এর সমান মর্যাদা আশা করতে পারত না। 

       ২. ভাতা প্রদান নিষিদ্ধ ঃ লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে "General Service Enlistment Act" দ্বারা ভারতীয় সিপাহিদের যেকোনো স্থানে যুদ্ধে যাওয়া বাধ্যতামূলক করেন। কিন্তু দূর দেশে যুদ্ধে গেলেও সিপাহীরা তাদের প্রাপ্য ভাতা পেতেন না। লর্ড ডালহৌসি এই ভাতা প্রদান ভারতীয় সিপাহিদের জন্য নিষিদ্ধ করে দেয়। 

       ৩. অমানবিক আচরণ ঃ ইংরেজ অফিসাররা ভারতীয় সিপাহীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ এবং খারাপ ব্যবহার করত। হিন্দু সিপাহীদের তিলক কাটা ও মুসলমান সিপাহিদের দাড়ি রাখার উপর ইংরেজ সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ইংরেজ সামরিক কর্মচারীরা ভারতীয় সিপাহিদের ঘৃণার চোখে দেখত।  সমসাময়িক একজন ইংরেজ  লিখেছেন, "এদেশীয় সিপাহী ও ইংরেজ উচ্চসামরিক কর্মীদের মধ্যে কোনো বন্ধুত্ব বা সহমর্মিতা বোধ ছিল না।  উভয়ই ছিল বিচ্ছিন্ন। ভারতীয় সিপাহিদের নিকৃষ্ট প্রাণি হিসেবে গণ্য করা হতো। কোন কারণ ছাড়াই ইংরেজ কর্মচারীরা সিপাহিদের শুয়োর, নিগার ইত্যাদি অশ্লীল ভাষায় সম্মোধন করত। 

সামাজিক কারণ :

       ১. সম্বোধন ঃ ইংরেজরা ভারতীয়দের ঘৃণার চোখে দেখত এবং তাদের ,"কালা আদমি", "বর্বর অসভ্য", "নেটিভ"প্রভৃতি বলে সম্বোধন করত। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে ওয়ারেন হেস্টিংস একটি মন্তব্য করেছিলেন যে, "কিছুদিন আগে পর্যন্ত অধিকাংশ ইংরেজই ভারতবাসীকে অসভ্য-বর্বর বলে মনে করত"। 

       ২. সামাজিক ব্যবধান ঃ ইংরেজদের এদেশে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ধন সম্পদ অর্জন করা। ভারতবর্ষের প্রতি তাদের কোনো সহানুভূতি ছিল না। সামাজিক ক্ষেত্রে তারা ভারতীয়দের পিছিয়ে রাখতে চেয়েছে। নিজেদের মনের দরজা ভারতবাসীর কাছে খুলে দেয়নি। ফলে শাসক ও  ভারতবর্ষের মধ্যে এক সামাজিক ব্যবধান-এর সৃষ্টি হয়। 

      ৩. মন্দির-মসজিদ ইত্যাদি ধর্মীয় স্থানে এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উপর ইংরেজরা কর আরোপ করে। 

ধর্মীয় কারণ :

     ১. ধর্ম নাশের চেষ্টা ঃ হিন্দু বিধবা বিবাহ আইন, সতীদাহ প্রথা রদ, স্ত্রীশিক্ষা, শিশুহত্যা নিবারণ ইত্যাদি ঘটনাগুলিকে ভারতবাসী ধর্ম নাশের  প্রচেষ্টা বলে মনে করে। 

      ২. ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা ঃ খ্রিস্টান মিশনারীরা ভারতবাসীদের খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করলে অসন্তোষ আরো বৃদ্ধি পায়। 

     ৩. খ্রিস্টান মিশনারীরা খ্রিস্টানধর্মকে জনপ্রিয় করার জন্য হিন্দু বা ইসলাম সম্বন্ধে নানা রকম কুৎসা রটনা করতেন। হিন্দু ও ইসলামের প্রচলিত ধর্মীয় রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান সম্পর্কে এরা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করতেন। 

Post a Comment

0 Comments