প্রশ্ন ঃ মেটারনিখ ব্যবস্থা ও তার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
উত্তর ঃ
👉 মেটারনিখ ব্যবস্থা
কূটনীতির বরপুত্র প্রিন্স ক্লেমেন্স মেটারনিখ ছিলেন অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও সমকালীন ইউরোপীয় রাজনীতির এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তিনি ছিলেন ইউরোপীয় রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক। এজন্য ঐতিহাসিক ফিশার ১৮১৫ থেকে ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই সময়কালকে 'মেটারনিখের যুগ' বলে অভিহিত করেছেন।
মেটারনিখ পদ্ধতি বা মেটারনিখ ব্যবস্থা ঃ যতদিন মেটারনিখ অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন ততদিন তিনি অস্ট্রিয়ায় এবং ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ভিয়েনা সম্মেলনের সিদ্ধান্তের দ্বারা ইউরোপের অন্যান্য দেশে তীব্র রক্ষণশীল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলির প্রধান উদ্দেশ্য নিন্মে আলোচনা করা হল -
(ক) ইউরোপে পুনরায় বিপ্লব পূর্ববর্তী রাজনৈতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা।
(খ) ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত উদারতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ প্রভৃতি প্রগতিশীল ভাবধারার অগ্রগতিকে রোধ করা।
(গ) নিজ দেশ অর্থাৎ অস্ট্রিয়ার স্বার্থসিদ্ধি করা এবং ইউরোপে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্যকে বজায় রাখা।
এই নীতিগুলি বাস্তবায়িত করার জন্য মেটারনিখ অস্ট্রিয়া তথা ইউরোপে যে দমনমূলক নীতির প্রবর্তন করেছিলেন তাকে 'মেটারনিখ পদ্ধতি' বা 'মেটারনিখ ব্যবস্থা' বা 'মেটারনিখ সিস্টেম' বলা হয়ে থাকে।
👉 মেটারনিখ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য
অস্ট্রিয়ার প্রধানমন্ত্রী মেটারনিখ তাঁর যে দমনমূলক নীতির মাধ্যমে অস্ট্রিয়া তথা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তাঁর রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন তাকে মেটারনিখ ব্যবস্থা বলা হয়।
মেটারনিখ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ঃ মেটারনিখ ব্যবস্থার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে আলোচনা করা হল -
(ক) পুরাতনতন্ত্র ঃ মধ্যযুগীয় অভিজাততন্ত্র, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র, পুরোহিততন্ত্র, ক্যাথোলিক গির্জার প্রাধান্য প্রভৃতি পুরোনো ভাবধারাগুলিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য মেটারনিখ আজীবন লড়াই চালিয়েছিলেন।
(খ) বিপ্লব-বিরোধিতা ঃ মেটারনিখ ফরাসি বিপ্লব ও বিপ্লব-প্রসূত আধুনিক ভাবধারাগুলির তীব্র বিরোধিতা করেছেন। যেমন- উদারতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র প্রভৃতি। মেটারনিখ মনে করতেন এগুলি সব রাজনৈতিক মহামারি।
(গ) পরিবর্তনের বিরোধিতা ঃ মেটারনিখতন্ত্রের মূল কথা হল স্থিতাবস্থা বজায় রেখে পরিবর্তনের বিরোধিতা করা। পরিবর্তন বিরোধী মনোভাবাপন্ন মেটারনিখ ইউরোপের সব রাজাদের পরামর্শ দিতেন, 'রাজত্ব করুন, কিন্তু কোন পরিবর্তন করবেন না।
(ঘ) অস্ট্রিয়ার প্রধান্য রক্ষা ঃ অস্ট্রিয়া ছিল বহু জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষের বসবাসের স্থান। ফলে সেখানে বিপ্লব-প্রসূত ভাবধারাগুলি প্রবেশ করলে সাম্রাজ্য ভেঙে যেত। এই কারণে মেটারনিখ চেয়েছিলেন পুরাতনতন্ত্র ফিরিয়ে এনে অস্ট্রিয়াকে রক্ষা করা এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে যেকোন উপায়ে অস্ট্রিয়ার প্রাধান্য ও নেতৃত্ব বজায় রাখা।
(ঙ) ইউরোপে পদক্ষেপ ঃ মেটারনিখ অস্ট্রিয়ায় রক্ষণশীল নীতি চালু করেছিলেন। কিন্তু তিনি সন্দেহ করেছিলেন ইউরোপের অন্যান্য দেশে বিপ্লবী ভাবধারা ছড়িয়ে পড়লে তা অস্ট্রিয়ায় প্রবেশ করে অস্ট্রিয়াকে ধ্বংস করতে পারে। এজন্য শুধুমাত্র অস্ট্রিয়া নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশেও তিনি আধুনিক ভাবধারা প্রতিহত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
মূল্যায়ন ঃ সবশেষে বলা যায় যে, মেটারনিখ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রিন্স ক্লেমেন্স মেটারনিখ ইউরোপের গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী ভাবধারাগুলিকে ধ্বংস করে রক্ষণশীল ভাবধারার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দেখা যায়, মেটারনিখ পুরোনো সমাজ ব্যবস্থাকে ধ্বংস থেকে কিছুদিন বিলম্বিত করতে পেরেছিলেন মাত্র, তিনি তা এড়াতে পারেননি।
equiz4u
0 Comments