১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দের ফরাসি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের পচনশীল পুরাতনতন্ত্রের ধ্বংসসাধন হয় এবং নতুন ও আধুনিক ভাবধারা ও আদর্শের বিকাশ ঘটে। ফরাসি বিপ্লব-প্রসূত তিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আদর্শ ছিল 'সাম্য', 'মৈত্রী' ও 'স্বাধীনতা'। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন ফ্রান্সের শাসন ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতা পাওয়ার পর তিনি বিপ্লবের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন কিন্তু তিনি স্বাধীনতার আদর্শ-সহ বিভিন্ন বৈপ্লবিক ভাবধারাকে ধ্বংস করেন।
রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ঃ বিপ্লবীরা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ফ্রান্সের বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু নেপোলিয়ন ফ্রান্সের শাসন ক্ষমতা দখল করার পর ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে নিজেকে 'সম্রাট' হিসেবে ঘোষণা করেন। এভাবে তিনি দেশে পুনরায় চূড়ান্ত স্বৈরাচারী বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলে বিপ্লবের মূল লক্ষ্যটিই ব্যর্থ হয়ে যায়।
স্বাধীনতার আদর্শ ধ্বংস ঃ নেপোলিয়ন ফ্রান্সের মানুষের স্বাধীনতা ধ্বংস করেন। তিনি -
(i) প্রাদেশিক আইনসভা গুলির ক্ষমতা হস্তগত করেন।
(ii) মানুষের বাক্ স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেন।
(iii) বিনা বিচারে যে কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হবে এমন নিয়ম চালু করেন।
(iv) নাটক ও নাট্যশালার ওপর পুলিশি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেন।
(v) সর্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কের ভোটাধিকার ঘোষণা করেন কিন্তু জনগণের প্রত্যক্ষ ভোট দানের অধিকার স্বীকার করেননি।
(vi) বুর্জোয়া শ্রেণীকে বেশি অধিকার ভোগের সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন।
শিক্ষাক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ ঃ নেপোলিয়ন বিপ্লবী জ্যাকোবিনদের সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার আদর্শকে বাতিল করেন এবং এমন শিক্ষার প্রবর্তন করেন যাতে শিক্ষার্থীরা সম্রাট ও রাষ্ট্রের প্রতি একান্ত অনুগত হয়ে থাকে। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা যাতে সম্রাট ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী না হয়ে ওঠে সেই উদ্দেশ্যে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে পরিবর্তন করেন।
বিপ্লবের সন্তান কি না ঃ ফরাসি বিপ্লবের বিভিন্ন ভাবধারাকে ধ্বংস করার জন্য বিখ্যাত ঐতিহাসিক জর্জ রুডে নেপোলিয়নকে 'বিপ্লবের সন্তান' বলে অস্বীকার করেছেন। নেপোলিয়ন নিজেও তার আত্মজীবনীতে কখনও নিজেকে 'বিপ্লবের সন্তান' আবার কখনও 'বিপ্লবের ধ্বংসকারী' বলে উল্লেখ করেছেন।
মূল্যায়ন ঃ উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বলা যায় যে, নেপোলিয়ন যখন বিপ্লব বিধ্বস্ত ফ্রান্সের শান্তি, স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনেন তখন তাকে নিঃসন্দেহ 'বিপ্লবের সন্তান' বলা চলে কিন্তু তিনি যখন গণতান্ত্রিক জনপ্রতিনিধি মূলক প্রতিষ্ঠানগুলির বিলোপ ঘটান, দেশে রাজতন্ত্র ফিরিয়ে আনেন এবং স্বাধীনতার আদর্শ ধ্বংস করেন তখন তিনি 'বিপ্লবের ধ্বংসকারী' হওয়ার পরিচয় দেন। এপ্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ওলারের একটি কথা বলা যায়, নেপোলিয়ন সামাজিক সাম্য অপেক্ষা বৈষম্য সৃষ্টি করেছিলেন। সুতরাং তিনি বিপ্লবের সন্তানের মত কাজ করার চেয়ে একজন ধ্বংসকারীর ভুমিকা বেশি করে পালন করেছেন তাই নেপোলিয়নকে 'বিপ্লবের ধ্বংসকারী' বলাই শ্রেয়।
আরও পড়ুন ঃ
(১) ধর্মসংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথারের অবদান আলোচনা করো।
(২) ফ্রান্সে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।
(৩) মেটারনিখ ব্যবস্থা ও তার বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
(৪) ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দকে বিপ্লবের বছর বলা হয় কেন।
(৫) ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লবের কারণ ও ফলাফল আলোচনা করো।
(৬) বাস্তিল দুর্গের পতন কীভাবে ঘটেছিল?
equiz4u
0 Comments