গান্ধীজী তৎকালীন ইউরোপ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, ইউরোপ শয়তানের প্রতিনিধিত্ব করছে। তিনি বলেছেন, ইউরোপ মূলত কুবেরের উপাসক। আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে গান্ধীজী এও বলেছেন যে, রেলপথ বা হাসপাতালের বিলোপ সাধন তাঁর উদ্দেশ্য নয়; কিন্তু যদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এগুলি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে তিনি অখুশি হবেন না বরং স্বাগত জানাবেন। কারণ, রেলপথ বা হাসপাতাল কোনটিই বিশুদ্ধ সভ্যতার পরিচয় বহন করে না বা এর থেকে সামান্যতম নৈতিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে না। আবার আইন-আদালতকেও ধ্বংস করার পক্ষে তিনি সরাসরি কিছু বলেননি ঠিকই কিন্তু তিনি একথা মনে করেন, আইন-আদালত, যন্ত্র প্রভৃতি ধ্বংসের জন্য যে অকপটতা ও ত্যাগের প্রয়োজন, জনগণ এখনো সেই স্তরে উন্নীত হতে পারেননি।
আত্মার বিকাশ ঃ গান্ধীজী তার রাষ্ট্রচিন্তায় মানুষের স্বাধীনতা, শ্রীবৃদ্ধি এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের কথা বলেছিলেন। তিনি চেয়েছেন আত্মার বিকাশ। কেন-না আত্মার বিকাশ ঘটলেই স্বাধীনতা, শ্রীবৃদ্ধি, নৈতিকতার ব্যাপ্তি সম্ভব। এজন্য সকলকে সবরকম মেধা ও কর্মনৈপুণ্য প্রদান করতে হবে।
আধুনিক সভ্যতার স্তম্ভ ঃ গান্ধীজীর মতে, আধুনিক সভ্যতার স্তম্ভ দুটি - একটি হলো 'আধুনিকতা' এবং অপরটি হলো 'প্রগতি'। এই দুটি স্তম্ভই মানুষের ক্রমবর্ধমান ভোগতৃষ্ণা মেটানোর জন্য শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে ভোগপণ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে। তিনি মনে করেন, আধুনিক সভ্যতা মানুষকে দিয়েছে শারীরিক সুখ আর বিলাসিতা। একইসাথে তা আবার ভোগবাদ উচ্ছৃঙ্খলতাকে উৎসাহিত করেছে। গান্ধীজী তার বিভিন্ন রচনায়, বিশেষ করে 'হিন্দ স্বরাজ, গ্রন্থে ভোগবাদের বিরোধিতা করে নানা মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ অতিরিক্ত পরিমাণে পণ্যের লোভে নিজের মনে শান্তি আনতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা শুধু এনেছে এক লাগামছাড়া অসংযত প্রতিযোগিতা। তাই গান্ধীজী চেয়েছেন, মানুষ তার নৈতিক মূল্যবোধের পরিবর্তন সাধন করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে ভোগবাসনার হ্রাস ঘটিয়ে কৃচ্ছ্রতার মনোভাব পোষণ ক্রুক।
পশ্চিমি সভ্যতার সমালোচনা ঃ গান্ধীজী যন্ত্রবাদের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু এ কথা কখনো বলেননি যে, যন্ত্র মানেই খারাপ কিছু। আসলে তিনি বড় আকারের শিল্পায়ন চাননি। এই কারণে তিনি উন্নয়নের পুঁজিবাদী মডেলের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছেন এবং পশ্চিমি সভ্যতার সামাজিক উৎপাদনের বিরুদ্ধেও সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যে, পশ্চিমী ব্যবস্থা মূলত যন্ত্রায়নের উপর নির্ভর করে যে সীমাহীন উৎপাদন বাড়িয়ে চলেছে, তা সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর। কারণ পণ্যদ্রব্যের অনিয়ন্ত্রিত উৎপাদন ব্যবস্থা এক প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করে; ফলে দেশের বাজারকে পরিপূর্ণ করার পর উৎপাদিত দ্রব্য সামগ্রীকে নিয়ে পাড়ি দিতে হয় উপনিবেশের সন্ধানে। এইভাবে পশ্চিমি সভ্যতা তার সামাজিক উৎপাদনের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির উপর নির্ভর করে সাম্রাজ্যবাদের পথে পা বাড়ায়। ব্রিটেনের কাছে ভারত ছিল এমনই একটি পণ্যের বাজার।
আত্মনির্ভর গ্রামসমষ্টির প্রতিষ্ঠা ঃ গান্ধীজীর লক্ষ্য ছিল কেবল স্থানীয় মানুষদের ভোগের জন্য পণ্যদ্রব্য প্রস্তুত করে এক আত্মনির্ভর গ্রামসমষ্টির প্রতিষ্ঠা করা। এই কারণে তিনি বড় আকারের শিল্পায়নের বিরোধিতা করেছেন। শহর ও গ্রামের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার নির্ধারক হলো বিনিয়োগ। কাজেই এই সম্পর্কগুলি ভীষণভাবে শোষণমূলক, সেই কারণে তিনি সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে বদলাতে চেয়েছিলেন।
শিল্পায়নের ফল ঃ গান্ধীজী আধুনিক সভ্যতার উপর এতটাই বিতৃষ্ণ ছিলেন যে, তিনি বলেছেন হাজার হাজার শ্রমিককে খাদ্যের অন্বেষণে একসঙ্গে কারখানা ও খনিতে পশুর মত পরিশ্রম করতে হয়। অর্থাৎ পুঁজিপতি অর্থাৎ ধনকুবেরদের জন্য শ্রমিকদের নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা ধরনের বিপদজনক কাজে যোগদান করতে হয়। তিনি মনে করেন, শিল্পোন্নত সভ্যতা পুরোপুরিভাবে পাপে পরিপূর্ণ এবং এটি একটি সামাজিক ব্যাধি। তাই এই সভ্যতা একদিন নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে যাবে। তবে তা দেখার জন্য ধৈর্য ধরতে হবে। বাষ্পচালিত জাহাজ আর তড়িৎবার্তা সম্পর্কে তিনি কোন আপত্তি তোলেননি ঠিকই, কিন্তু শিল্পবাদ বলতে সেই সবকিছু বোঝায়, যা সরল বা সাধারণ চিন্তাধারা থেকে ভিন্নতর। ভ্রান্ত ধারণার বশে আজ যারা নিজের চাহিদাকে উন্মত্তের মতো বাড়িয়ে চলেছে, তারাই একসময় উপলব্ধি করবে যে মানব সম্পদই হলো প্রকৃত সম্পদ।
পরিশেষে আধুনিক সভ্যতার সমালোচনা করে গান্ধীজি বলেছেন যে, সংসদীয় রাজনীতিতে নীতিবহির্ভূত কারণেই রাজনৈতিক দল স্বার্থপর এবং এই চিন্তাধারার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলের মতাদর্শ। রাজনৈতিক দলগুলি বিত্তবান ব্যক্তিদেরই প্রতিনিধিত্ব করে এবং সুবিধাজন পর্যায়ে উন্নীত হয়।
আরও পড়ুন ঃ
১. অছি ব্যবস্থা সম্পর্কে গান্ধিজির ধারণা ব্যাখ্যা করো।
২. গান্ধিজির খেদা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
৩. সর্বোদয় সম্পর্কে গান্ধিজির চিন্তাধারা ব্যাখ্যা করো।
৪. গান্ধিজির সত্যাগ্রহ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করো।
Equiz4u
0 Comments