প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় বিদেশি সাহিত্যের ভূমিকা/গুরুত্ব -
প্রাচীন যুগ থেকে ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, দর্শন, ধর্ম ইত্যাদির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিভিন্ন সময়ে বহু বিদেশী পর্যটক এই দেশে এসেছিলেন। তারা ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে নিজেদের অভিজ্ঞতার বিবরণ লিখে গেছেন। বিদেশি পর্যটকদের এইসব বিবরণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে স্বীকৃত। বিদেশি পর্যটকদের বিবরণকে কতগুলি ভাগে ভাগ করা যায়, যথা - গ্রিক বিবরণ, রোমান বিবরণ, চিনা লেখকদের রচনা ও আরবি পর্যটকদের বিবরণ ইত্যাদি।
পরবর্তী উল্লেখযোগ্য গ্রিক বিবরণ হল পলিবায়াসের লেখা সাধারণ ইতিহাস গ্রন্থ। এছাড়া একজন অজ্ঞাতনামা গ্রিক নাবিকের লেখা পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সি গ্রন্থটি থেকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের ভারতীয় বন্দর, আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য এবং রোম-ভারত বাণিজ্যের সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। টলেমির লেখা ভূগোল গ্রন্থ থেকে সমকালীন ভারতের অরণ্য, নদনদী ও প্রাণীকুলের বিবরণ আমরা জানতে পারি।
চিনা লেখকদের বর্ণনা ঃ প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন যুগে বহু চীনা পর্যটক এসেছিলেন যাদের বিবরণ ভারতের ইতিহাস রচনায় গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে কাজে লাগে। ফা-হিয়েন গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় ভারতে এসেছিলেন। তাঁর লেখা ফো-কুয়ো-কি গ্রন্থ থেকে গুপ্ত যুগের তথা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে জানাযায়। হিউয়েন সাং হর্ষবর্ধনের সময়ে ভারতে আসেন এবং তাঁর লেখা সি-ইউ-কি গ্রন্থটি থেকে হর্ষবর্ধনের প্রশাসন, ধর্ম, বাণিজ্য এবং উত্তর ভারতের রাজনৈতিক অবস্থার কথা জানতে পারি। তেমনি ই সিং-এর রচনা থেকে গুপ্তদের আদি বাসস্থান সম্পর্কে এক সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। এছাড়া তিব্বতের ঐতিহাসিক লামা তারানাথের বিবরণ থেকে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার সংক্রান্ত বহু তথ্য আমাদের সামনে উঠে আসে।
রোমান লেখকদের বিবরণ ঃ গ্রিকদের বর্ণনার পাশপাশি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে রোমান লেখকদের বর্ণনাও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। কার্টিয়াসের বর্ণনা থেকে যেমন আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ঘটনা জানা যায় তেমনই প্লিনির লেখা প্রাকৃতিক ইতিহাস গ্রন্থ থেকে রোম-ভারত বাণিজ্য, সমকালীন বন্দর, বাণিজ্যপথ প্রভৃতি সম্পর্কে বিশদে জানা যায়।
আরবের লেখকদের বর্ণনা ঃ উত্তর ভারতে মুসলমানদের জয়লাভের কাহিনী জানতে হলে আমাদের সুলেমান, আল বিরুনী প্রমূখ আরবীয় লেখকদের বিবরণের সাহায্যের প্রয়োজন হয়। সুলেমান পাল রাজা দেবপালের সময় ভারতে আসেন এবং পাল রাজা মহীপালের সময়ে আল-মাসুদি ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন। এই দুই লেখক-এর বর্ণনা থেকে পাল যুগের ইতিহাস সম্পর্কে বহু বিষয় জানা যায়। আল-বিরুনী সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের সময় ভারতে আসেন। তিনি তহকিক-ই-হিন্দ গ্রন্থে ক্ষয়িষ্ণু ভারতের ধর্ম, সমাজব্যবস্থা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে বিশদে লিখে গেছেন। এগুলি ভারতের ইতিহাস রচনায় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।
সীমাবদ্ধতা ঃ ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে বিদেশি সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর মধ্যে বেশ কিছু ত্রুটি দেখা যায়। যেমন- বিদেশীরা স্বল্প সময়ে ভারতে থাকায় ভারতের বিভিন্ন ধরনের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতি সম্পর্কে সঠিক ধারণা অর্জন করতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশীরা জনশ্রুতির ভিত্তিতে তাদের বিবরণ লিখেছেন। আবার প্রথমদিকে তারা নিরপেক্ষ বিবরণ দিলেও পরে তারা রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে তাদের প্রতি পক্ষপাত দেখিয়েছেন এবং তারা নিজেদের রচনায় ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসকে গুরুত্ব দেননি।
উপসংহার ঃ উপরোক্ত ত্রুটিগুলি সত্ত্বেও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় বিদেশি লেখকদের বর্ণনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে তথ্য যাচাই করার ক্ষেত্রে বিদেশিদের বিবরণকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই ভারতের প্রাচীন ইতিহাসকে পূর্ণাঙ্গ রূপ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রত্নতাত্তিক উপাদানের সঙ্গে বিদেশি সাহিত্য নির্ভরযোগ্য উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
আরও জানুন ঃ
১. প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দেশীয় সাহিত্যের গুরুত্ব আলোচনা করো।
0 Comments